শুধু দুজনায় (শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:১৫:৩০ দুপুর
২.
যখন সময় থমকে দাঁড়ায় >>
বৃষ্টি তখনো থামে নাই। সবাই ট্রেন থেকে নেমে ছাউনির নীচে অপেক্ষা করছে। কিছু উৎসাহী তরুন-তরুনী বৃষ্টিকে শরীরে মেখে নিতে ছাউনি ত্যাগ করছে। যাদের ছাতা আছে তারা সেটা নিয়ে বের হল। তবে এদের সংখ্যা নেহায়েত কম। কারণ এটা হল অবেলার বৃষ্টি। রেখা ও রাসেল নেমে এলো। দুজনে ষ্টেশনের পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। যাবার পথে থেমে থাকা ট্রেনের ভিতরে 'জুটি'দের উপস্থিতি টের পায়। যদিও সেদিকে তাকাতে হয় নাই। তবে না তাকিয়ে ও আজকাল অনেক কিছু উপলব্ধি করা যায়। এই বোধটা যদি আরো ১৫ বছর আগে আসতো!
রাসেল রেখাকে লক্ষ্য করে। কিছু একটা ভাবছে। সবার থেকে ওরা একটু সরে এসেছে। রেখার পাশে এসে ওর হাত আবার ধরে। একটা ছেলে যখন একটা মেয়ের হাত ধরে তখন মেয়েটা কি উপলব্ধি করে সেটা জানার অনেক ইচ্ছে ছিল রাসেলের! আজ কি রেখাকে জিজ্ঞেস করবে? শেষে করেই ফেলে-
: কেমন লাগছে?
: কোনটা বলব?
:সব ক'টা বল।
: মানে? - ঘুরে রাসেলের দিকে তাকায় রেখা। ও কি বলতে চায়, সেটা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু রাসেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়। নাহ! ...
: আমার সাথে সেই পুরনো জায়গা গুলোতে এসে কেমন লাগছে?
: খুব ভাল লাগছে!
: আর আমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে?
: মনে হচ্ছে, এই জায়গায় আমি এই প্রথম এলাম। সময় যেন থমকে আছে সেই ১৯৯৮ এ।
: হ্যা! চল, উপরে উঠি। বৃষ্টি থেমে গেছে।
১৯৯৮ থেকে বের হয়ে ২০১৪ এ পৌঁছাতে ওদের সময় লাগে না। এক একটা ধাপ বেয়ে মউর দোকানের দিকে আগাতে থাকে... পিছনে ফেলে আসে এক একটা কষ্টকর বছর। একটা ধাপ- জীবনের ওপারে ফেলে আসা সকল না পাওয়া... অন্যটা বর্তমানকে সুদৃঢ় করে আগামীকে নিরাপদ করার বাসনা।
এভাবে দুজনে রাস্তাটা পার হয়।
অনাগত শ্বাপদসঙ্কুল রাস্তাটা ও কি এভাবেই...?
মনের জানলা খুলে দিলাম >>
‘মউর দোয়ান’!
একটা নাম যেটা সময়ের একটা নির্দিষ্ট অধ্যায়ের ঘ্রাণকে পেতে সাহায্য করে বলে মনে হল রাসেলের। সেই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়। সেই হোটেলটি যেখানে ট্রেন থেকে নেমেই দলবেঁধে সেখানে ঢুকে পড়া... কত হাসি-ঠাট্টা আর প্রাণের সাথে প্রাণের মিল হয়েছে এই মউর দোকান থেকে। কত নতুন কবির জন্ম হয়েছে এখানে... তার প্রথম পাঠক- শ্রোতা ও ছিল এখানে। প্রেমিক , রাজনীতিবিদ কিংবা বাউন্ডুলে-যাযাবর- সব ধরণের বন্ধুদের মিলনমেলা ছিল এই মউর দোকান।
আলহাজ্জ গুড়া মিয়া সওদাগর যিনি ‘মউ’ নামে পরিচিত ছিলেন রেখাদের কাছে... সবার কাছেই... এখনো প্রায় একই রকম রয়েছেন। রেখা রাসেলকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে একটা কোণা খুঁজে নেয়... ওদের প্রিয় সেই নস্টালজিক টেবিলটাতে বসে। চিরাচরিত সেই চা আর সিংগাড়া চাইলো। মুখোমুখি হয়ে প্রথম কথা-
: তোমার মনে পড়ে রাসেল, এখানে বসেই আমাকে প্রোপোজ করেছিলে?
: হ্যা! – ভারী স্বরে জানালো রাসেল। ... কিন্তু এখান থেকেই তুমি আবার আমার থেকে চলে গিয়েছিলে... মাসুদের সাথে।
: কখনো জানতে চাইলে না কেন গিয়েছিলাম?
: প্রয়োজন মনে করি নাই। আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম...
: এখন কি বাস না?
: আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম এবং এখনো বাসি! তাই তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছি... নিজের কষ্টকে চেপে রেখেছি তোমার আনন্দের জন্য। আমি তখনো জানতে চাই নি... আজও চাচ্ছি না এবং ভবিষ্যতে ও চাইবো না।
: রাসেল!
: বাদ দাও ওসব। পুরনো ক্ষতকে খুঁচিয়ে কেন কষ্ট বাড়ানো?
হোটেলের বয় সিঙ্গাড়া নিয়ে এলো। সাথে পিঁয়াজ কুচি করে কাঁটা। সে চলে যেতেই রাসেল রেখার দিকে তাকিয়ে কিছু দেখলো। ওর নেকাবটা এখনো রেখেছে। এজন্য মুখের পুরোটা সে দেখতে পাচ্ছে না। আগের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে আরো কি যেন একটা ওর চেহারায় এসেছে। এটা কি বন্য কোনো কিছু? নাকি সংসার জীবনে এই ১৫ বছরের লাভ করা কিছু অভিজ্ঞতার মিশেল... ওর কমনীয় মুখচ্ছবিতে একটা বয়সের ছাপ এনে দিয়েছে।
বয়স!
সেটাও তো কম হয় নি। কিন্তু জীবন ওদেরকে নিয়ে যে ছেলেখেলা খেলেছে, তাতে মনের দিক থেকে অনেক আগেই ওরা বুড়িয়ে গেছে। নিঃশব্দে দুজন খেতে থাকে।
চা শেষ করে কাপটা টেবিলের উপর রাখে। রাসেলের চোখের দিকে তাকিয়ে এক গভীর ভাবনায় ডুবে যায় রেখা। আশপাশ ওর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ওকে যিনি তৈরি করেছেন তিনি ওর পরিনতিও তৈরি করেছেন । যা ই হয় , তিনি রেখাকে সব সময় আগলে রেখেছেন । তিনি ওর সাথে সব সময় থেকেছেন । কখনো ভুল বুঝেন নি। বরং সে ই না বুঝে কষ্ট পেয়েছে বার বার । আর অন্যদেরকে ও দিয়েছে।
রাসেলকে যেমন দেয় ...সবাইকে যেমন দেয় ...নিজেকে যেমন দেয়...
কিন্তু যার জন্য এই পরিস্থিতি সেই মাসুদকে কেন জানি কোনো কষ্টে জড়াতে পারে না। এই অবস্থায় কিভাবে জড়াবে সে রাসেলকে ওর সাথে ? অনেক কষ্ট করছে সে ওর জন্য ।
আজ এতোদিন পরে ফেসবুকে ওর সাথে নতুন করে দেখা... ফ্রেন্ডশীপ... পুরনো সম্পর্ককে নতুন ভাবে ঝালাই করে নেয়া আর কি! সেখানেই ইনবক্সে ওর না বলা সব কথা অনেকবার সে রাসেলকে বলতে চেয়েছে। কিন্তু রাসেল সেই বরাবরের মতই ই একরোখা... শুনতে চায় নি। আজও যেমন শুনলো না।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল রেখা।
সব কিছুই কি গোপন করা যায়?
চাইলেও কি পারা যায়? রেখার দীর্ঘশ্বাস রাসেল অনুভব করে। সেখানে লুক্কায়িত কষ্টটা সহ-ই সে অনুভব করে। কিন্তু সে ওর কষ্টকে লাঘব করার জন্য অতীতকে টেনে আনতে চায় না। তাতে রেখার কষ্ট কিছুটা কমলেও ওর নিজের পৌরুষের একটা অপমানের দগদগে ক্ষতকে আবার তাজা করা হবে।
মাঝে মাঝে ভাবে কিছুদিনের জন্য সব লেনদেন বন্ধ করে রেখাকে নিয়ে একা এক কোণায় কোখাও চলে যায়। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে প্রতি মুহূর্তে হারতেই থাকে। তবু ভিতরে আশা থেকেই যায় ।
রেখা রাসেলের হাতদুটো তুলে নেয়। টেবিলের উপর রেখে সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে ওর নেকাবটা পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে মুহুর্তেই আগের রেখায় পরিণত হয়। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রাসেল নীরব হয়। কি এক অমোঘ আকর্ষণে একেবারে হিপনোটাইজড হয়ে রেখার কথা শুনতে থাকে।
:রাসেল! আমার খুব ইচ্ছা হয় তোমাকে ভালোবাসি , তোমার হই, সবটুকু দিয়ে তোমার সব পাই ...... এলোমেলো কত কিছু করি । মনে হয় এভাবে বোধ হয় পাবো , আবার মনে হয় - না, অন্যভাবে চাইতে হবে ... আমি চাইতেই থাকি ... মন বলে পাবো । অপেক্ষা করি। অনেক সময় কাউকে মনে হয়, তুমিই সেই জন ... কাছাকাছি গেলেই মনে হয় তাকে না, অন্য শুধু তোমাকে চাই ... ফিরে আসি ... মনে হয় তোমাকে ফেলে আসলাম ... আবার ফিরি ... মানুষের নাম বদলে যায় ততক্ষণে ... আবার শুরু থেকে পরিচয় ... একই সেই পরিণতি ... মন বলে এভাবেই যেন ধীরে ধীরে কাছাকাছি চলে আসছি ... আবার মনে হয় পথের শুরুতে ফিরে গেছি ... কেন এমন হয়?
: আমি জানি না... আমি কিচ্ছু জানি না!
:তোমার মনের জানালাটা খুলে দিয়ে দেখ। সেখানে কি বলে।
দুজন নর-নারী মধ্য বয়সে এসে ‘মউর দোয়ানে’ বসে তাদের মনের জানালায় উঁকি দিতে চেষ্টা করে- সেখানে কি এখনো তাদের জন্য অবশিষ্ট কিছু রয়েছে কি না? যাকে অবলম্বন করে তাঁরা এগিয়ে যেতে পারে!
যদি আর একটু সময় পেতাম>>
ক্ষণিকা কটেজের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে দু’পাশে সারি সারি গাছ কে ফেলে তীরের মত সোজা পীচ ঢালা পথটা ধরে ওরা দুজন এগিয়ে চলল। রাসেলের খুব মজা লাগছিল। সব কিছু স্বপ্নের মত লাগছে। সবুজ ধান ক্ষেতগুলোকে একই রকম লাগে, সব সময়ই এই মাঠ-ঘাট-ক্ষেত একই রকম ওর চোখে। ওরা দুজন একেবারে সেই মাজারের কাছে চলে এলো। যেখানে বসে রেখাকে সে প্রথম কিস করেছিল। সে অনেক সাধনার পরে একবারের জন্য শুধু। তবে সেই পাওয়াটাই এখন পর্যন্ত রাসেলের জীবনের সেরা কিছু প্রাপ্তি।
রেখাও মনে মনে হাসছিল। রাসেলের মনে কি ভাবনা চলছে এই মুহুর্তে, সেও বুঝতে পারছে। জীবনে কোনো ছেলেকে দেয়া এক একান্ত অনুভুতি...দুর্লভ... নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এক মুহুর্তের জন্য... আবার চকিতে নিজের ভিতরে ফিরে আসা। এমনই এক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তারা এই মাজারের এখানটায়। আজ আর ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ এখানে আসার সময় মনে হয়েছিল, এই জায়গাটিকে অন্তত নিজের মনে হবে। কিন্তু কেন হচ্ছে না? তবে কি অনুভুতির গোড়াটা একেবারেই শুকিয়ে গেছে? দিনের পর দিন মাসুদের সুরা আর সিগ্রেটের কর্কশ পুরুষালী ঠোঁটের রমনে ও কি ওর অনুভুতির কবর রচনা করেছে!
একটা খালি রিক্সা মদনহাটের দিক থেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। হাতের ইশারায় রাসেল থামায়। রেখার দিকে নীরবে তাকায়। কিছু বলা লাগে না। উঠে বাম পাশে বসে। রাসেল উঠতেই রিক্সাওয়ালা প্যাডেল মারতে থাকে। রেখার শরীর থেকে কি যেন বাতাসে ভেসে ভেসে রাসেলকে মাতাল করে তুলছে। আদৌ কি কিছু ভেসে আসছিল? নাকি এটা ওর হৃদয়ের ভিতর থেকে ভালবাসার ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে!
রেখা মনে মনে চাচ্ছে সেই আগের মতো রাসেল ওর বা হাত দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরুক। ওর হাতের সেই স্পর্শে রেখা যাতে হারানো পনেরটি বছর ফিরে পায়।
পনেরটি বছর এক হিংস্র পশুর সাথে বসবাস করছে সে। যে শুধুমাত্র নারীকে ভোগের সামগ্রী ও উন্নতির পথের সিড়ি ছাড়া আর কিছুই বোঝে নাই। বিয়ের পর থেকেই ওর আসল রুপ রেখা দেখে এসেছে। প্রথম প্রথম ভাবতো এটা সময়ের দোষ। সময়েই কেটে যাবে। কিন্তু একজন পুরুষের ভিতর মদ-জুয়া’র নেশা থাকলেও সে এতটা ধ্বংস হয়না- যতটা ধ্বংস হবে পরনারীতে আসক্ত হলে। মাসুদের এই খারাপ নেশাটা ছিল। সে ছিল একজন বহুগামী কামুক বিকৃত রুচির মানুষ। কিন্ত ওর সাথে প্রথম দেখা হবার দিনগুলোতে তার স্বভাবের ভিতর এই খারাপ রুপ কেন রেখার চোখে পড়ল না? আসলে দুর্জনের ছলের অভাব যেমন হয় না, তেমনি মুখোশ ধারণ করতেও এরা কম পারদর্শী নয়।
রিক্সাওয়ালা এক নাম্বার গেইটে এলে রাসেল বাম দিক দিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকতে বলে রেখাকে জিজ্ঞেস করে-
: কাটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যাবে নাকি?
: আসার সময় ওখান দিয়ে আসি?
: ঠিক আছে।
ওদের পাশ থেকে কাটা পাহাড় সরে যায়। ওরা দক্ষিণ ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। জীবনের অনেক কিছুই আমাদের পাশ দিয়ে হঠাৎ সরে যায়... কিছু আস্তে আস্তে যায়। আমরা দেখেও দেখি না কিংবা দেখতে চাইনা। রাসেল বলে-
: তোমার ছেলেমেয়েদের কথা বল।
: কি বলবো?
: কেমন আছে ওরা, ওদের নামগুলো বললেও তো জানতে পারি।
: তুমি কি ওদেরকে কখনও দেখেছ? শুধু শুধু নাম জেনে আর কি হবে?
: তুমি একজন পরাজিত মানুষের মত কথা বলছ।
: হ্যা, পরাজিত। কিন্তু মেয়েমানুষ! পরাজিত পুরুষ হলে ক্ষতি ছিল না, না?
: তুমি ভাল করেই জানো আমার কাছে মেয়ে-পুরুষ বলতে কিছু নাই।
: আমি তোমার কাছে কি ছিলাম?
: তুমি শুধুই রেখা ছিলে! আমার রেখা! ... কিন্তু এখন অন্যের।
: কেন কেড়ে নিলে না? বাঁধা দিলে না? যখন তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলাম, কেন জোর করলে না?
: কি অধিকারে?
: ভালবাসার!
: সেজন্যই তো বাঁধা দেই নাই। ভালবাসি বলেই তো চেয়েছিলাম সুখী হও।
: হাহ! সুখ!
দুজনের কেউই এবার কিছু বলল না। রিক্সা ভিসি’র পাহাড়ের পাশ কাটিয়ে শহীদ মিনারের সামনে। দুজনেই অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। রেখা বলল -
: কেন বিয়ে করে সুখী হলে না?
: সুখের নমুনা তো তোমাকে দিয়েই দেখতে পাচ্ছি।
: সবাই তো রেখা হবে এমন কথা নেই।
: হ্যাঁ! সবাই রেখা নয় বলেই বিয়ে করি নাই।
রেখার হৃদয়ের ভিতরে কথাটা একাধারে ভাললাগার এবং কষ্টের অনুভুতি নিয়ে এলো। ওর পাশের এই একরোখা মানুষটির জন্য এই মুহুর্তে ওর ভিতরে এক প্রচন্ড ভালবাসা তৈরী হয়েছে। কিন্তু কিভাবে প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না। নিজেকে সম্পুর্ণ বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর সামনে। কিন্তু ওর কি আছে যা দিয়ে ওর জন্য চীরকুমার এই মানুষটাকে কিছুটা হলেও শান্তি দিতে পারে? ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠল রেখা।
ইস! যদি আর একটু সময় পেতো !
রিক্সাটা সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে এসে গেছে। ভর দুপুরে সকল মানুষের ভিতর রেখা রাসেলের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পশু জীবনে অভ্যস্ত এক নারীর এই নীরব কান্নার পাশে থেকে রাসেলের হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এক মাথা এলোমেলো চুল নিয়ে সে রেখার কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল... নীরবে... ভাষাহীন দৃষ্টি মেলে... অপেক্ষা করে।
রিক্সাটা ছুটে চলেছে চাকসু ভবন ছাড়িয়ে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের দিকে।
রাসেলের ও আরো একটু সময় প্রয়োজন...
বৃষ্টি দেখে অনেক কেঁদেছি>>
রেখা শান্ত হল।
অনেক সময় লাগল। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টটার পাশে সবুজ ঘাসের উপর ওরা অনেকক্ষণ বসে রইলো। এই সময়টাতে রাসেল ওর এই ১৫ বছরের না বলা কথা রেখাকে শোনাতে চাইল। কিন্তু এত অল্প সময়ে কি জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস গুলোকে বের করা যায়?
কিছুই বলা হল না। শুধু দুজনে একে অপরকে অনুভব করতে চাইল। দুটি মন আজ যেন ওদের নিজেদের নেই। আর যে কথাগুলো ওদের হৃদয়ে রয়ে গেছে, সেগুলো আজ চোখের তারায় এসে জমা হয়েছে যেন। না হলে কেন এই চোখে চোখে তাকিয়ে থাকা!?
ক্যাফেটেরিয়া হয়ে কলাভবন... জারুলতলায় ঝুপড়ি দোকানগুলোতে... সেগুলো পেরিয়ে ঝর্ণার কাছে... লাইব্রেরীর সিড়ির উপরে... মেডিকেল সেন্টারে... আইন অনুষদের পাহাড়টাতে... সেন্ট্রাল খেলার মাঠে... আ.ফ. রহমান হলের কাছের চাঁপা গাছগুলোর নীচে... ফরেস্ট্রির বিশাল এলাকাটায়... বোটানিক্যাল গার্ডেনে - এই সব জায়গাগুলোতে ফেলে আসা দিনের দম বন্ধ করা নস্টালজিয়ায় ভোগার মত কিছু রসদের সন্ধানে ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে এলো। কিছু পেলো... কিছু পেলো না।
সময় অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে... অনুভব করল।
দুপুরের খাবার ক্যাফেটেরিয়ায় খেয়ে নিলো। কলাভবনের সামনে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড হোটেলের মতো ছিল। সেখানে যাবার কথা ভুলেই গেলো।
হেঁটে হেঁটে কাঁটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে দুজনে আসছে। আরো অনেকে আসা যাওয়া করছে। এ যেন এক শ্রেনীবদ্ধ জীবন! শুধু যাওয়া আসার খেলা। মনে মনে রাসেল দার্শনিক হয়ে গেল। সেখানে বিষয়বস্ত একটি, হৃদয়- ওর পাশের এই মেয়েটির।
মউর দোকানের পাশের দোকানটি ছিল ‘বজল মামার’। জোবরা গ্রামের একজন স্থানীয় তিনি। রাসেলের সাথে অনেক সুন্দর একটি সম্পর্ক ছিল। স্টেশনের দক্ষিণ পাশের একটি টিলা তার দখলে ছিল। সেখানে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি থাকতেন। আজ তাকে দেখার বড় ইচ্ছে হল রাসেলের। রেখাকে বলতে সেও যেতে চাইল।
রেললাইন পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটতে হল। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নাকি ওর চোখের দেখার ভুল? মাটির একটা টিলা। মাটি কেটে কেটে বানানো সিড়ি দিয়ে দুজনে উপরে উঠে এলো। মাটির ঘর। উপরে ছনের ছাউনি। এই ঘরের একটা রুম ভাড়া করে রাসেল দীর্ঘদিন থেকেছে। ছাত্র অবস্থায়।
বজল মামা একটা দা দিয়ে বাঁশের কি যেন চাঁচছিলেন। প্রথমটায় চিনতে পারলেন না। কিন্তু রাসেল যখন হাসি দিয়ে ‘মামা’ বলল, তিনি ও হেসে উত্তর দিলেন। আজম খানের সেই কালজয়ী গানের মত-
‘... ধর অনেক পরে, আবার দেখা হল তোমার সাথে
যখন তুমি ও বদলে গেছো আমি ও বদলে গেছি
কি বলে ডাকবে বল আমাকে
তখন না হয় একটু হেসো...’
দুজন মানুষ যারা দীর্ঘ ১৫ টি বছর একে অপরের থেকে সমস্ত সম্পর্ক নিয়েই বিচ্ছিন্ন ছিল, আজ শুধু একটু হাসি দিয়েই একে অপরকে চিনে নিল!
ওরা দুজনে আলিঙ্গন করল। শহর আর গ্রামের দুটি হৃদয়কে এক হতে দেখে কেন জানি রেখার চোখে পানি এসে গেল।
ওদেরকে ঘরের ভিতরে বসিয়ে মামা আপ্যায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মামী এবং বাচ্চারা সবাই কুমিল্লায় মামার শ্বশুর বাড়িতে। তিনি একাই। ওদেরকে বসিয়ে রেখে তিনি নিচে নেমে গেলেন। এই ঘরটাতেই রাসেল ছিল। মাটির ঘরে থাকার একটা আলাদা মজা আছে। শীতে ঘরম আর গরমে ঠান্ডা লাগে।
রেখা বিছানার উপর বসে আছে। ফুল-লতাপাতার ডিজাইনে বিছানার চাদরটায় বসে থাকা ওকে দেখে রাসেলের মনের ভিতরটায় কেমন যেন করে উঠল। আকাশের অবস্থা ও খারাপ হয়ে উঠছে। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকের সাথে মেঘের গর্জনের কিছুটা পরেই চারদিক ঝাপিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো।
রেখা এই পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করল না। মনে মনে সে এমনই একটা পরিবেশ চাইছিল। যে জিনিসটি রাসেলকে কখনো দেয়া হয় নাই, আজ রিক্সায় বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার সময় সে ওকে ‘কিছু একটা’ দিতে চেয়েছিল। তবে এমন একটা পরিবেশে তো সবই সম্ভব- চিন্তাটা রেখাকে ব্যকুল করে তুললো। ওর চোখ আগুন হয়ে ঊঠলো।
রাসেল ও ভাবছিল। রেখার বর্তমান জীবনের কথা... মাসুদ নামের একটা নর-পশুর সাথে কীভাবে প্রতিটি মুহুর্ত মানসিক কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে ওর এই প্রিয়তমা... সেখান থেকে ওকে কীভাবে মুক্তি দেয়া যায়?... এইসময় রেখার নিস্পাপ সন্তানগুলো রাসেল-মাসুদ আর রেখার মাঝে এসে দাঁড়ায়। একটা সিদ্ধান্ত নিতে নিতেও রাসেল নিতে পারে না।
এমন সময় রেখা বিছানা থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়ায়। ওর নেকাব এবং বুকের চাদর মাটিতে ফেলে দেয়। এখনো রেখার এই বয়সে শরীরের গাথুনি রাসেলকে দেহ মনে এক অনাবিল আনন্দের সঞ্চার করায়। সে ভাবে এই তো... ওর সামনে দাড়িয়ে থাকা এই মানবী- যাকে পাওয়ার জন্য কত রাত... কত দিন সে কেঁদেছে... যন্ত্রনায় ছটফট করেছে... নিজের অক্ষমতায় পালিয়ে বেড়িয়েছে! আজ সে ওর সামনে। সম্পুর্ণ ভাবে নিজেকে সারেন্ডার করছে। ওর কি করা উচিত?
রেখা রাসেলের চোখে তাকিয়ে একেবারে ওর মনের ভিতরে চলে যায়। সেখানে বসেই বলে-
: আমাকে এক দন্ড শান্তি দিতে পার?
রাসেল রেখার ব্লাউজের পাশ দিয়ে যে যায়গাটুকু উন্মুক্ত সেখানে কালসিটে দাগ দেখতে পেল। মুখের নীচে এবং গলায় পুরনো ক্ষতি চিহ্ন দেখল। এটা যে সেই পশুর কাজ বুঝে সীমাহীন এক ক্রোধে রাসেল কষ্ট পেতে থাকে। অনেক কাছে টেনে নিয়ে রেখাকে আদর করতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু যাকে পাবার জন্য বছরের পর বছর নীরবে অপেক্ষা করেছে- তপস্যা করেছে; আজ এতো সহজে সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও কেন গ্রহন করতে পারছে না?
শুধু রেখার কাঁধে দুটো হাত রাখে। রেখা কেঁপে উঠে একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে।
দুটো অতৃপ্ত ঠোঁট একে অপরের কাছে আসার জন্য অস্ফুট-অপেক্ষায়... এক মানবী এক দন্ড শান্তি পাবার প্রতীক্ষায়... ১৫টি বছরের সাধনার ফল এক মানবের সামনে... বাহিরে উত্তাল পরিবেশ... প্রচন্ড বৃষ্টি... ঝড়... প্রকৃতিতে... দুটি হৃদয়ে... রেখা ওর শরীর ভেদ করে একটা ধানের শীষ গভীরে পেতে চাইছে... রাসেল প্রচন্ড গরমে একটা শান্ত দীঘির জলে সাঁতার কাটতে চাইছে...
স্ট্যাচুর মতো পাহাড়ের উপরে এক মাটির ঘরে দুটো দেহ কাছাকাছি... এক হবার অপেক্ষায়... বৃষ্টি দেখে কেঁদে চলেছে...
কি হবে?
কি হওয়া উচিত???
বিষয়: সাহিত্য
১০৭২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
আপনার নান্দনিক মন্তব্যে আমি অভুভূত ভাইয়া!
ব্লগে সময় নিয়ে পড়বার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন